আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বরফের চাদরে ঢাকা প্রান্তর। ঝুরো বরফের চাদর সরিয়ে পাতা-ডালপালার বাসার মধ্যে ঘন নীল রঙের ডিম দেখে তাক লেগে গিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। এমন চকচকে, গাঢ় নীল রঙের ডিম কীভাবে হল? ধূ ধূ মরু অঞ্চলে বা মালভূমি এলাকায় আবার ডিমের রঙে খয়েরি-লালের খেলা। অথবা নানা রঙের ছিটে সাদা খোলার গায়ে। পাখির ডিমের এই নানা রঙের কারণ নিয়ে গবেষণা দীর্ঘদিনের। প্রাণীবিজ্ঞানীরা এতদিনে সাফ বুঝে গিয়েছেন, ডিম শুধু সাদা হয় না, এলাকা ভেদে এবং জলবায়ুর ফারাকে ডিমের রঙও বদলে যায়।
‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন’ জার্নালে ডিমের রঙের বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন নানা দেশের বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় উঠে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন রঙের খেলা শুরু হয়ে যায় পাখির জরায়ুতেই। ডিমের খোলায় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট কোষ থাকে। রঙিন ডিম মানেই তাতে রঞ্জক পদার্থ থাকবে। বাইরের এবং ভিতরের পর্দা (মেমব্রেন) পেরোলে অ্যালবুমিনের আস্তরণ। তার ভিতরে কুসুম (Gelatinous Egg White)। বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রোটিনের এই স্তর আগে তৈরি হয়, তারপর তাতে রঞ্জকের রঙ ধরে। শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক টিম বার্কহেড বলছেন, ডিমের রঙ কী হবে সেটা স্থির হয়ে যায় জরায়ুতেই। যে স্থানে পাখি ডিম পাড়ছে সেখানকার আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, বাসার গঠন, শত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা সবকিছু বিচার করে সঙ্কেত পাঠায় পাখির মস্তিষ্ক। সেই সঙ্কেতের ভিত্তিতেই জরায়ুতে ডিমের গঠন সম্পূর্ণ হয়। কখনও তার প্রোটিন বেষ্টনী মজবুত ও পিচ্ছিল হয়, কখনও ডিমের খোলসে রুক্ষ ভাব আসে আবার কখনও খোলার রঙে বৈচিত্র্য আসে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডিমের খোলা বা বাইরের আবরণীতে এই রঙের কারণ মূলত নানা রকম রঞ্জক। দু’টি রঞ্জক এর মধ্যে বেশি সক্রিয়—প্রোটোপরফিরিন (Protoporphyrin)যা ডিমে লালচে খয়েরি আভা আনে এবং বিলিভার্ডিন (Biliverdin)যার কারণে ডিম ঘন নীল বা সবুজ রঙের হয়। এই দুই রঞ্জকের কমবেশিতে রঙেও বৈচিত্র্য আসে। যেমন কেট্টি’স ওয়ার্বলার পাখিদের ডিমে প্রোটোপরফাইরিন একাই বেশি থাকে, তাই ডিমের রঙ ঘন লাল বা লালচে খয়েরি হয়। আবার দুই রঞ্জকের কমবেশিতে নানা রঙের মিশ্রণ দেখা যায় ডিমের খোলায়।
নিউ ইয়র্কের হান্টার কলেজের পিএইচডি স্কলার মার্ক হবার তাঁর The Book of Eggs বইতে লিখেছিলেন, বিশ্বের নানা দেশের কিছু ফ্লাইক্যাচাররা নানা রঙের ডিম পাড়ে। এদের ডিমের রঙ বদল হতে থাকে। জাপানি কিউয়েলরা আবার কখনও খয়েরি রঙের ডিম পাড়ে, আবার কখনও নীল। আর এটা তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন এই রঙের বৈচিত্র্য কেন, তার সম্ভাব্য কিছু কারণ সামনে এসেছে।
প্রথমত—জলবায়ুর বৈচিত্র্য। শীতপ্রধান দেশের পাখিদের ডিমের রঙ যা হবে, গ্রীষ্মপ্রধান বা নাতিশীতোষ্ণ এলাকার পাখিদের ডিমের রঙ তার থেকে অনেকটাই আলাদা হবে। এর কারণ, ডিমের ভিতরে তাপমাত্রার ভারসাম্য ধরে রাখা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাঢ় রঙ সূর্যরশ্মি শোষণ করে বেশি, ফলে শীতপ্রধান এলাকায় ডিমের ভিতরে উষ্ণভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত—সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি বা আলট্রাভায়োলেট রশ্মির থেকে ভ্রুণকে বাঁচায় এই গাঢ় রঙের খোলস। Thermal Regulation এই রঙের ভেদের আরও একটা বড় কারণ।
তৃতীয়ত—শিকারিদের নজর থেকে ডিমকে নিরাপদে রাখা। দেখআ গেছে, হালকা রঙে শিকারিরা আকৃষ্ট হয় বেশি। গাঢ় রঙ পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকে, নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। ফলে সহজে ডিম চিনে উঠতে পারে না শিকারিরা। সাধারণত দেখা যায়, মজবুত বাসা তৈরি করতে পারে না যে সব পাখিরা, বা খোলা জায়গায় ডিম পাড়ে যারা, তাদের ডিমের রঙ প্রায় সবসময়েই গাঢ় রঙের হয়।
আমেরিকার বিজ্ঞানীরা ৬৩৪ রকম পাখির প্রজাতি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। দেখা গেছে শুধুমাত্র বাহ্যিক কারণ নয়, জিনগত কারণও রয়েছে এই রঙের বৈচিত্র্যের পিছনে। আগামী গবেষণাপত্রে সেই ভেদ খোলা হবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সুত্র: দ্য ওয়াল
মতিহার বার্তা ডট কম – ২৯ অক্টোবর ২০১৯
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.