শিরোনাম :
প্রেমিকার বাড়ির সামনে বিষপানে প্রেমিকের মৃত্যু; বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য ‘শাড়ি ক্যানসার’ কেন হয়? তার উপসর্গই বা কী? জানালেন চিকিৎসক ডায়াবেটিকেরাও ভাত খেতে পারেন, তবে মানতে হবে কিছু নিয়ম মল্লিকার সঙ্গে চুমু বিতর্ক, মুখ দেখাদেখি বন্ধ কুড়ি বছর, সাক্ষাৎ পেয়ে কী করলেন ইমরান? ক্যাটরিনার জন্যই সলমনের সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব, ইদে স্বামীকে নিয়ে ভাইজানের বাড়িতে আলিয়া! রাজশাহী মহানগরীতে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার ২৬ ১৬ মাসের মেয়েকে বাড়িতে একা রেখে ছুটি কাটাতে যান মা, না খেয়ে, জল না পেয়ে মৃত্যু! সাজা যাবজ্জীবন রাজশাহীতে ট্রাকে টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজি, আটক ২ পুঠিয়ায় পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে গ্রেফতার ৩ ঈদের সাথে যুক্ত হওয়া নববর্ষের উচ্ছ্বাসে বিনোদন স্পট পরিপূর্ণ
বিক্রি হওয়া সন্তানকে ফিরে পেতে মায়ের আকুতি

বিক্রি হওয়া সন্তানকে ফিরে পেতে মায়ের আকুতি

মতিহার বার্তা ডেস্ক: জন্মের পরই দত্তকের নামে বিক্রি হয়ে যায় একটি শিশু সন্তান। তাকে ফেরত পেতে এক বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন মা। পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দুয়ারে ধরনা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার কোলে সন্তান ফেরেনি।

এ নিয়ে সালিশ বসলেও সমাধানের পরিবর্তে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে। যাদের কাছে সন্তান বেড়ে উঠছে তারা এক বছর আগে তাকে ফিরিয়ে দিতে ২০ হাজার টাকা দাবি করেছিল। অথচ তারাই এখন তিন লাখ টাকার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। অনুসন্ধানে এমনই একজন মা ও তার সন্তানের ‘জিম্মি’ থাকার ঘটনা জানা গেছে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, টাকার জন্য কারও সন্তানকে জিম্মি করে মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখা অবৈধ। টাকার বিনিময়ে সন্তান ফেরত নেওয়ার সালিশও আইনের পরিপন্থী। কেউ কারও কাছে টাকা পেলে তা আদায়ের জন্য পৃথক আইন রয়েছে। সন্তান আটকে টাকা আদায়ের সুযোগ নেই।

অসহায় এই মায়ের নাম আরিফা বেগম। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণী পেশায় গৃহকর্মী। ২০১৬ সালে মহাখালীর একটি বাড়িতে কাজ করার সময় গাড়িচালক লুৎফুর রহমান বাবুর সঙ্গে তার প্রেম হয়। এরপর বিয়ে করে তারা আদাবরে ওঠেন। কিন্তু বিয়ের দু’বছর পর তাকে ফেলে পালিয়ে যায় স্বামী। ততদিনে আরিফা সন্তানসম্ভবা। তবে মনোবল হারাননি তিনি। সন্তান জন্ম দিয়ে নিজেই তাকে বড় করে তুলতে চেয়েছেন।

২০১৯ সালের ৯ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) একটি কন্যাসন্তান জন্ম দেন আরিফা। কিন্তু প্রসব পরবর্তী শারীরিক জটিলতার কারণে তাকে নিতে হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। তখনই প্রশ্ন ওঠে নবজাতক কার কাছে থাকবে।

আরিফা বলেন, “আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। হাসপাতালে এক নারীকে বোন বানিয়েছিলাম। মেয়ে হওয়ার পর চিকিৎসক জানতে চাইলেন, ‘নবজাতককে কার কোলে দেবো?’ তাদের বললাম, আমার কোলে দিন। চিকিৎসক বলেন, ‘আপনি তো অসুস্থ।’ তাই বললাম, তাহলে বাইরে আমার বোন আছে, তার কোলে দিন। হাসপাতালে যাকে বোন বানিয়েছিলাম, নার্সরা তার কোলে আমার মেয়েকে দেয়। আর আমাকে আইসিইউতে রাখা হয়।”

হাসপাতালের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, কথিত সেই বোনের নাম মবিয়া। অস্ত্রোপচারের আগে সব কাগজপত্রে আরিফার অভিভাবক হিসেবে এই নামই দেওয়া। ঠিকানার জায়গায় লেখা– লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর।

আরিফা জানান, কোলে পাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ‘মেয়ের চোখ ফোলা ও চিকিৎসা করাতে হবে’ বলে নবজাতককে নিয়ে ঢামেক হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান মবিয়া। এরপর তিনি আর কখনও সন্তানকে হাতে পাননি।

২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট আরিফা ঢামেক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু সন্তানের কথা জানতে চাইলেই এড়িয়ে যেতে থাকেন মবিয়া। তার বর্ণনায়, ‘হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমার মেয়েকে চাই। একদিন কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের একটি বাড়িতে আমাকে নিয়ে যায় মবিয়া। সেখানেই আছে আমার সন্তান। সেখানে যে পরিবার থাকে তারা নাকি আমার মেয়ের চিকিৎসার খরচ দিয়েছে, তাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাদের কাউকে চিনি না।’

তখন সন্তান ফেরত চাইলে আরিফার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বসেন মবিয়া। তার সাফ কথা ছিল, টাকা দিয়েই মেয়েকে ফেরত নিতে হবে। আরিফা  বলেন, ‘তখন আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা ছিল না, তাই মেয়েকে নিয়ে আসতে পারিনি।’

মবিয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের পর মোহাম্মদপুর থানার সামনের এলাকায়  সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হন। এখানেই একটি বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকেন। তার নাম হাসপাতালে মবিয়া লিখলেও এলাকায় তিনি মীনা নামে পরিচিত। তার আরেক নাম সাথী।

আরিফার মেয়েকে এক দম্পতির কাছে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেন মবিয়া ওরফে মীনা। আরিফার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন, ‘সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে আমিই আরিফাকে ঢামেকে নিয়ে যাই। রাতে তার সঙ্গে ছিলাম। নবজাতককে চিকিৎসার জন্য আরেকটি হাসপাতালে নিতে হয়েছে। তাকে আইসিইউতে রাখতে হয়েছিল। আমার কাছে এত টাকা ছিল না, আমি গলার হার বন্ধক রেখেছিলাম। এভাবে তাকে সাহায্য করেছি।’

মবিয়া ওরফে মিনা ওরফে সাথীজন্মের পর নবজাতককে আরেক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার আগে আরিফার অনুমতি নিয়েছিলেন কিনা প্রশ্ন করলে মবিয়ার দাবি, ‘আরিফার মা ও ভাই ওই পরিবারকে দিয়ে গেছে। আরিফা নিজেও আমাকে মেয়ে পালতে বলেছিল। সে একেক সময় একেক কথা বলে।’

তবে মবিয়ার এই দাবি অস্বীকার করেছেন আরিফা, ‘আমার মেয়েকে কারও কাছে তুলে দিতে বলিনি। আমি জানতামই না আমার মেয়ে অন্য কারও হাতে চলে গেছে। আমার অনুমতি ছাড়া আমার মেয়েকে অন্য পরিবারের কাছে দেওয়া হয়েছে।’

আরিফার মা নুরুন্নাহার বেগম থাকেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। পরিবারে নতুন মানুষ আসার খবর পেয়ে রাতেই ছোট ছেলেকে নিয়ে রওনা হন তিনি। ঢাকায় পৌঁছান পরদিন ভোরে। নাতনিকে দেখতে ফোন করেন মবিয়াকে।

আরিফা জানতে পেরেছেন, ঢাকার একটি সড়কে কয়েক মিনিটের জন্য শিশুটিকে দেখিয়ে আনেন মবিয়া। ঢাকায় কয়েক দিন থাকার পর আরিফার মা ও ভাই বাড়িতে চলে যান। মবিয়া তাদের হাতে সাত হাজার টাকা দেন।

সুনামগঞ্জে থাকা নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার মেয়ে ঢাকায় কাজ করে খায়। তার সন্তান হওয়ার খবর শুনে ঢাকায় গিয়েছিলাম। এর আগে আমরা কখনও ঢাকায় যাইনি। সেখানে কিছু চিনি না। ঢাকায় গিয়ে জানলাম, মবিয়া নামের একজনকে আরিফা বোন ডেকেছে। তার কাছেই নাতনি আছে। আমাদের একদিন রাস্তায় বসে তাকে দেখালো। নাতনিকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মবিয়া মনে করেছে সে অনেক অসুস্থ, আমরা লালন-পালন করতে পারবো না। তাই আমরা তাকে মবিয়ার কাছেই রেখে এসেছি। বিশ্বাস করেছিলাম তাকে। কারণ, আমার মেয়ের বিপদের সময় সে সাহায্য করেছে। কিন্তু এরপর আর আমাদের নাতনিকে দিলো না। সে জন্মের এক সপ্তাহ পর পরিবারটি বললো, ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমরা তখন অল্প কিছু টাকা দিয়ে নাতনিকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন দিলো না। তারা বলে, নাতনিকে আমরা বাঁচাতে পারবো না। এখনও তারা একই কথা বলে। এক বছর ধরে আরিফা মেয়ের জন্য পাগল হয়ে ঘুরছে। কিন্তু পরিবারটি অনেক টাকা চায়। আমরা এত টাকা কোথায় পাবো?’

আরিফার মেয়ে বর্তমানে মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের ৭ নম্বর সড়কে একজন হোটেল ব্যবসায়ীর বাসায় আছে। তার নাম জালাল গাজী। তিন ছেলে হলেও গাজী দম্পতির কোনও মেয়ে নেই। অনেক দিন ধরেই তারা মেয়ে শিশু দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। মবিয়ার কাছ থেকে তারা ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে এই নবজাতককে নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন।

জালাল গাজীর পরিবার কীভাবে এই নবজাতককে পেয়েছেন, সেই গল্প বাসার আশপাশের অনেকেই জানেন। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের ৯ আগস্ট রাতে আমার বাসার পাশের এক চাচির মাধ্যমে জানতে পারি, ঢামেকে একটি মেয়ে দত্তক নেওয়া যাবে। এরপর সাথী ওরফে মবিয়ার সঙ্গে আমরা ফোনে কথা বলি। সিএনজি নিয়ে রাত ১২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে ওই বাচ্চা নিয়ে পান্থপথের একটি হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে তিনদিন আইসিইউতে রাখি। এরপর বাসায় নিয়ে আসি। আরিফাকে খাবার-দাবার পোশাক কিনে দিয়েছি। আর মবিয়া পেয়েছে ১৭ হাজার টাকা। যতদূর জানি, সে টাকা নিয়ে আরিফা ও তার পরিবারকে দিয়েছে।’

যদিও মবিয়া দাবি করেছিলেন, শুরুতে তিনি স্বর্ণের হার বন্ধক রেখে চিকিৎসা করিয়েছেন। তার দাবি, ‘আমি সৎ। আমি যাদের মেয়ে দিয়েছি, তাদের কাছ থেকে বিনিময়ে কিছুই নেইনি।’

আরিফার অভিযোগ নিয়ে মোহাম্মদপুরের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর রোকসানা আলম গত ১০ জুলাই একটি সালিশ বৈঠক করেন। তার স্বামী কে, সন্তান বৈধ কিনা– সালিশে এসব প্রশ্ন তোলা হয়। ওই বৈঠকে আরিফার বক্তব্য রেকর্ড করে তাকে বিভিন্ন অপবাদ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরিফার অভিযোগ, মবিয়া ওরফে মীনা ও জালাল গাজী বিভিন্ন হাসপাতালে তার মেয়েকে চিকিৎসা করানোর রসিদ বের করেছেন বৈঠকে। একটি স্ট্যাম্পও দেখানো হয়। জালাল গাজী বলেন, ‘আমাকে মবিয়া ওরফে সাথী ওরফে মীনা ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিতভাবে মেয়েটিকে দত্তক দিয়েছে। সেখানে আরিফা ও তার মধ্যে বাচ্চা দেওয়ার একটি চুক্তি হয়েছে। ১৭ হাজার টাকার কথাও উল্লেখ আছে।’

তবে আরিফা জানিয়েছেন, তিনি কোনও স্ট্যাম্পে কখনোই স্বাক্ষর করেননি। এগুলো নকল। স্ট্যাম্পের সঙ্গে তার স্বাক্ষরের কোনও মিল নেই। সালিশ বৈঠকে কাউন্সিলর শর্ত দিয়েছেন, মেয়েকে ফিরে পেতে হলে আরিফাকে দুই লাখ টাকা এবং তার স্বামী, মা ও ভাইকে নিয়ে আসতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাড়পত্রএসব ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউন্সিলর রোকসানা আলম বলেন, ‘মহিলা (আরিফা) অবিবাহিত। সে সন্তান জন্ম দিয়েছে। বাচ্চার স্বীকৃতি চাইতে যাওয়ার পর এক লোক তার শরীর পুড়ে দিয়েছে। এক নারীর মাধ্যমে মা-ই বাচ্চাকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। এখন আরেকজন খদ্দের পেয়েছে, তাই বাচ্চাকে বেশি দামে বিক্রি করতে জালাল গাজীর কাছ থেকে বের করে নিতে চায়। বাচ্চার চিকিৎসায় পরিবারটি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করেছে। অথচ তাদের টাকা না দিয়েই বাচ্চা ফেরত চায়। এটা তো হতে পারে না। আমি মহিলাকে (আরিফা) তার পরিবার ও খরচ যা হয়েছে তা নিয়ে আসতে বলেছি। তাহলে বাচ্চা দিয়ে দেবো। এটা মোহাম্মদপুর থানার ওসি জানেন।’

তবে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনও ঘটনা আমাদের কাছে আসেনি। আমাদের কাছে এরকম কিছু এলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেবো। তারপর অন্য ব্যবস্থা হবে। যে নারী কাউন্সিলর বলেছেন আমি বিষয়টা জানি, তিনি আমাকে চেনেনই না।’

মোহাম্মদপুর ও শাহবাগ থানায় মেয়েকে উদ্ধারে সাহায্য চেয়েছিলেন আরিফা। মোহাম্মদপুর থানা তাকে জানিয়েছে, যেহেতু ঢামেক হাসপাতালের ঘটনা তাই শাহবাগ থানায় যেতে হবে। এরপর আরিফা শাহবাগ থানায় যায়। কিন্তু শাহবাগ থানা ফের মোহাম্মদপুর থানায় পাঠিয়ে দেয়। এরপর আরিফার জানানো ঠিকানায় যান মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নূর ইসলাম। সেখান থেকেই বিষয়টি কাউন্সিলরের সালিশে গড়ায়।

মায়ের কাছ থেকে সম্মতি ছাড়া তার সন্তানকে টাকার বিনিময়ে আরেকটি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া আইনের চোখে অপহরণ বলে বিবেচিত হয়। শিশুকে ফেরত দিতে মায়ের কাছে অর্থ দাবি করাকে গুরুতর অপরাধ উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। তিনি বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০-এর ৮ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনও ব্যক্তি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে কোনও নারী বা শিশুকে জিম্মি করেন, তাহলে তা অপরাধ। এটি প্রমাণিত হলে অভিযুক্তরা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

আইনজীবী ইশরাত হাসানের মন্তব্য, ‘যারা বর্তমানে শিশুটিকে লালন-পালন করছেন তারাও অপরাধী। যে উদ্দেশেই বাচ্চাটিকে রাখা হোক না কেন, মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা অপরাধ। মনে রাখতে হবে, মুসলিম আইনে দত্তকের কোনও সুযোগ নেই, শুধু অভিভাবক হওয়া যায়। তবে আদালতের আদেশ ছাড়া এ ধরনের অভিভাবক হওয়া সম্ভব নয়। তাই দণ্ডবিধির ৩৬৮ ধারা অনুযায়ী শিশুর আইনত অভিভাবক আছে জেনেও তাকে এভাবে আটকে রাখার জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। আর কেউ সালিশ বা অন্য কোনও প্রতারণার মাধ্যমে এই অপরাধে সহায়তা করলে তারাও একই দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।’

ইশরাত হাসান মনে করেন, জালিয়াতির মাধ্যমে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য স্ট্যাম্প তৈরি করা অপরাধ। তিনি বলেন, ‘কারও কাছে পাওনা থাকলে তার সন্তান জিম্মি করে পাওনা আদায় করা যাবে না। পাওনা আদায়ের জন্য আলাদা আইন রয়েছে। শিশুকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা যাবে না। আরিফা আদালতের শরণাপন্ন হলে তিনি মেয়েকে ফেরত পাবেন। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’

জালাল গাজীর পরিবারে যত্নের সঙ্গে বেড়ে উঠছে শিশুটি। বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সবার সঙ্গে তার বেশ সখ্য। তারা নিজের মেয়ে হিসেবেই তাকে লালন-পালন করছেন। এ বছরের ৯ আগস্ট তার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। তারা মেয়েটির নাম রেখেছেন জান্নাত।আলাপের একপর্যায়ে জালাল গাজীর স্ত্রী বলেন, ‘মেয়েটি যখন সাত দিন বয়স, তখন আরিফাকে বলেছিলাম নিয়ে যা। তখন কম খরচ হয়েছিল টাকা, তখন নেয়নি। এখন সে আসে কেন? আমরা তো তাকে চিনি না। মীনার কাছ থেকে আমরা মেয়ে নিয়ে এসেছি। আমরা মেয়েকে শিশু হাসপাতাল, আল মানার ও ইবনে সিনায় চিকিৎসা করিয়েছি। আমাদের দুই-তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকা দিয়ে সে মেয়ে নিয়ে যাক। আমরা এতদিন যে লালন-পালন করেছি, আমাদের এই মায়ার দাম কি দিতে পারবে আরিফা?’

কিন্তু আরিফার বক্তব্য, তিনি আগেই টাকা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। তার ভাষ্যে, ‘মেয়ের যখন এক মাস একদিন বয়স তখন ২০ হাজার টাকা নিয়ে গিয়ে বলেছি, বাকি টাকা কাজ করে ধীরে ধীরে দিয়ে দেবো। কিন্তু তারা আমার মেয়েকে ফেরত দেয়নি। উল্টো আমাকে মারধর করেছে।’

সন্তানকে দেখতে আরিফা দু’বার কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের ওই বাসায় গিয়েছিলেন। এ নিয়ে পরিবারটির অভিযোগ আছে। জালাল গাজীর কথায়, ‘সে তো এই মেয়ে নিয়ে লালন-পালন করতে পারবে না। অন্য কোথাও বিক্রি করবে। আমরা জিজ্ঞাসা করেছি, তোমার আর কোনও চাহিদা আছে? থাকলে বলো, আমরা আরও কিছু টাকা-পয়সা দেই। কিন্তু কিছু বলে না।’

আরিফাকে মবিয়া জানিয়েছে, শিশুটির হার্টে সমস্যা আছে, যার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। আর চিকিৎসায় যত টাকা খরচ হয়েছে সেই টাকা দিয়েই মেয়েকে ফেরত নিতে হবে। এভাবে ৫০ হাজার টাকার দায় এখন গিয়ে ঠেকেছে তিন লাখে। তখন তিনি মবিয়াকে বলেন, ‘ঠিক আছে বুইন, উপকার যখন করছো, আমি তোমাদের টাকা দিয়ে মেয়ে ফেরত নেবো। কিন্তু তারা আমাকে মেয়ের কাছে যেতে দেয় না। মেয়েকে দেখতে দেয় না।’

আরিফা এখন প্রায়ই বোরকা পরে লুকিয়ে নিজের মেয়েকে দেখতে যান। মেয়ে হাসে, খেলে, আর মা দূর থেকে দেখে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে আসেন। তিনি জানেন না, এত টাকা দিয়ে মেয়েকে কীভাবে ছাড়িয়ে আনবেন। তার জানা নেই, মেয়েকে কবে নিজের কোলে ফিরে পাবেন। সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন

মতিহার বার্তা ডট কম – ১৭ আগষ্ট ২০২০

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply