শাহিনুর রহমান সোনা: স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীতে বুলেটের আঘাতে পীঠের বেশীরভাগ অংশ ঝলসে যাওয়া আর স্প্রিন্টারের অসহ্য ক্ষত যন্ত্রণা নিয়ে তিনি শোনালেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আব্দুস সাত্তার (ক্রমিক নং ১৩২) , পিতা নয়েন তুল্লা মন্ডল। জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ জুলাই তৎকালীন রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন মোহরাজপুর গ্রামে।
পেশাগত জীবনে সর্বশেষ নববই এর দশকে পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসেবে অবসরে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালিন দিনাজপুর পুলিশ লাইনসে টগবগে তরুণ হাবিলদার।
রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ’র ভাষণে উদ্বুদ্ধ হন তরুণ হাবিলদার আব্দুস সাত্তার। যদিও ভাষণটি শুনতে পেয়েছিলেন ৮ মার্চ সকালে দিনাজপুর পুলিশলাইনস থেকে। সেদিন নন বাঙালী রেসিডেন্সিয়াল ইন্সপেক্টর সাত্তার মামুদ’র জামাই একজন মেজর তাদেরকে বলেন, ” তোমহারা মুলক আজাদ হো জায়গা, লেকিন বহুত খুন জায়েগা “।
বাঙালী পুলিশরা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে থেকে
সরকারকে অসহযোগিতা শুরু করে আর
নন বাঙালী পুলিশদের নিরস্ত্র করেন। ২৫ মার্চ রাতে ওয়ারলেস এ তিনবার শতর্ক বার্তা আসে, “All station Attention”
পাক আর্মি আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে, আমরা প্রতিরোধ করছি”।
রাত ১২ টায় পুলিশ লাইনস এর রেসিডেন্সিয়াল ইন্সপেক্টর এর কাছ থেকে অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নেন তারা।
ইপিআর ও পুলিশ লাইনস এর মাঝামাঝি সার্কিট হাউসে অল্প কিছু ফোর্স ছিল।
২৭ মার্চ জিপ গাড়ী আগে, পেছনে একট্রাক ফোর্স নিয়ে সেই মেজর পুলিশ লাইনস এর দিকে আসতে থাকলে তাদের ফিরে যেতে বলেন পুলিশ সদস্যরা, তারা ফিরে যায়। এরপর ২৮ মার্চ সার্কিট হাউজ আক্রমণ করেন পুলিশ সদস্যরা, সেদিন পাক আর্মিদের ১১ জন নিহত হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়।
১ ১ এপ্রিল দিনাজপুর মুক্ত হলো…
টাউন থেকে ১০ মাইল দূরে আমরা শত্রুর মোকাবলা করার জন্য অবস্থান নিয়েছিলাম। কিন্তু সৈয়দপুর ক্যানটনমেন্ট থেকে ট্যাংক আক্রমণ হলো, আমরা পিছু হটতে বাধ্য হলাম, কারণ ট্যাংক আক্রমণ প্রতিহত করার মত ভারী অস্ত্র আমাদের কাছে ছিল না।
আমরা পশ্চিম দিনাজপুর বালুর ঘাট হয়ে মালদা চলে গেলাম। লাল গোলাতে জমায়েত হয়ে ৭ নং সেক্টর এর সাবসেক্টর ৪ এ ক্যাপ্টেন গিয়াস এর আন্ডারে ভর্তি হই।
অভয়া ব্রীজ রাজশাহী নবাবগঞ্জ রোডে মে-জুন মাসে আমাদের পরথম অপারেশনে সিলেটের তৌহিদুল কন্সটেবল শহীদ হন, পরবর্তীতে বীর বিক্রম উপাধী পান তিনি। এরপর কুষ্টিয়ার মহিষকুন্ডি (দৌলতপুর থানার কাছে) আমরা অ্যাটাক করি, নদীতে পানি থৈ থৈ, আষাঢ় শ্রাবণ মাস
সেদিন ১০-১১ জন পাক সেনা নিহত হয়।
১৭ নভেম্বর ইসলামপুরে ৭ ও ৮ নং সেক্টরের যৌথ অপারেশনে আমাদের ৯ জন শহীদ হন। এরমধ্যে সৈনিক মোহর আলী, ইপিআর এর নাহিদ কাশেম, নিজাম উদ্দিন সহ আরো ৭ জন ছিলেন। পরে
বীর প্রতীক বদিউজজামান টুনু-সহ
আমরা ১৭ জন রাজাকারকে ধরে আনি ; এরমধ্যে পিচ কমিটির চেয়ারম্যান শুকুর উদ্দিন ছিল ; ৪ নং সেক্টরের চিফ মেডিকেল অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: ইমদাদুল হক কাছে তাদেরকে নিয়ে যাই। শুকুর উদ্দিন’কে যৌথ বাহীনির হাতে তুলে দিয়ে, বাঁকি ১৬ জনকে আমরা মেরে ফেলি।
সর্বশেষ নবাবগঞ্জ শহরের(কল্যানপুর) বিডিআর ক্যাম্পে অবস্থান কারি পাকবাহিনীর সাথে লাগাতার ৯০ ঘন্টা যুদ্ধ চলে আমাদের (১১-১৪ ডিসেম্বর)।
রাজারামপুর নবাবগঞ্জ কলেজের পিছনে ডান পায়ে গুলি লাগে আমার, পিঠে এসে লাগে বুলেট। পায়ের গুলি ভেদ করে বের হয়ে যাওয়ায় রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। সার্জিক্যাল সুঁচ শেষ হয়ে যাওয়ায় ডা: ইমদাদ কাঁথা সেলাইয়ের সুঁচ দিয়েই আমার পা সেলাই করেছিলেন। এর পর আর আমার কিছু মনে নেই। পরবর্তীতে শুনেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর রুহুল আমিন প্রামানিক ও কয়েকজন আমাকে ও যুদ্ধাহত আরো কয়েকজনকে বহরমপুর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিছুটা সুস্থ হলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি নদীপথে ট্রলারে করে ডা: ইমদাদ আমাকে নিয়ে এসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
তাঁর বিষয়ে রাজশাহীর বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: মো: আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, তিনি অত্যান্ত সাহসিকতার সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। তাঁকে মহান মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে পদবীতে ভূষিত করা উচিৎ। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটা আমার দাবি।
“রাজশাহীর আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: ফজলুল হক বলেন, রাষ্ট্রীয় পদবীর পাশাপাশি তাঁর পীঠের স্প্রিন্টার গুলো বের করা আর উন্নত চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি ; কারণ ৫০ বছর পার হলেও এখনও পর্যন্ত তাঁর পীঠে পচন ধরা থামেনি, অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তাঁকে দিন কাটাতে হয়।
মতিহার বার্তা / ইএবি
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.