অনলাইন ডেস্ক: নওগাঁর মান্দায় অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অন্যের জমি জবরদখল করে ধান রোপণ, টর্চারসেলে নির্যাতনের পর ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর, দিন-দুপুরে অন্যের হাঁস ধরে জবাই করে পিকনিক খাওয়াসহ বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে সন্ত্রাসী সুমন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে। টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো বাহিনীর অন্যতম সদস্য সৌরভের গভীর নলকূপের ঘর। এ বাহিনীর তাণ্ডবে গত ১০ মাস ধরে এলাকাছাড়া রয়েছে একটি পরিবার।
বাহিনীর সদস্যদের হাতে যৌন হয়রানির ভয়ে এলাকার সুন্দরী নারী কিংবা স্কুল শিক্ষার্থীরা বাইরে যেতে পারেন না। ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ এলাকায় আগত দর্শনার্থী নারী-পুরুষদের ফাঁদে ফেলে টাকা ও মোবাইলফোন ছিনিয়ে নেওয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে এ বাহিনীর বিরুদ্ধে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস না পেলেও বাহিনীর প্রধান সুমন ও তার ৩ সহযোগী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে যাবার পর একে একে বেরিয়ে আসছে এসব তথ্য। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
এ বাহিনীর প্রধানের পুরো নাম মেহেফুজুল আলম সুমন (৩৫)। তিনি উপজেলার মান্দা সদর ইউনিয়নের বাদলঘাটা গ্রামের মৃত সোলাইমান আলী শাহের ছেলে। সুমন ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া ছিলেন। এসএসসি পাসের পর লেখাপড়া না করে জীবিকার সন্ধানে রাজধানী ঢাকায় চলে যান। সেখানে এক সেনার কর্মকর্তার গাড়ির চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এক সময় গাড়িটি নিজের বলে অন্যত্র বিক্রি করে দেন। বিষয়টি জানতে পেরে গাড়িসহ সুমনকে আটক করেন ওই সেনা কর্মকর্তা। পরে সুমনের ছোটভাই জমি বিক্রি করে ১০ লাখ টাকায় তাকে ছাড়িয়ে নেন। এরপর ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরে গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার বাদলঘাটা, হাড়কিশোর ও কুসুম্বা গ্রামের ১০-১২ জন যুবককে নিয়ে সুমন গড়ে তুলেছে ক্যাডার বাহিনী। বাহিনীর অন্যতম সদস্যরা হলেন, মাইনুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন, লালু মন্ডল, আনোয়ার হোসেন, মাসুদ রান, সৌরভ হোসেন, সুলতান। এছাড়াও আরও কয়েকজন যুবক তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগী মনোরঞ্জন সাহা জানান, পাওনা পরিশোধের কথা বলে গত ১১ মার্চ বিকালে মনোরঞ্জন ও তার কাকীমা কাজলি রাণীকে নিজ এলাকায় ডেকে নেন সুমন। বাড়িতে না নিয়ে বাদলঘাটা গ্রামের বোরো ধানের মাঠের সৌরভের গভীর নলকূপের ঘরে নিয়ে তাদের আটক করে রাখা হয়।
তাদের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে ব্যাপক নির্যাতন করে সুমন ও তার বাহিনীর সদস্যরা। পরে তিনটি ফাঁকা চেক, কয়েকটি সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরসহ তার কাছে থাকা ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনি সুমনসহ বাহিনীর ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে মান্দা থানায় মামলা দায়ের করেন। আরেক ভুক্তভোগী নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঈশ্বর দেবত্তর গ্রামের মতিউর রহমান জানান, গত ৩০ মার্চ বিকালে কালামারা ব্রিজ এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাফেরার সময় সুমন তার বাহিনী নিয়ে সেখানে হানা দেয়। এসময় তাদের মারপিট করে ৩ হাজার টাকা ও একটি মোবাইলফোন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় সুমনসহ তার বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী মতিউর রহমান।
উপজেলার জিনারপুর গ্রামের আরেক ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান জানান, তার ব্যক্তিমালিকানার একটি ট্রাক্টর রায়হান নামে একটি ব্যক্তির নিকট ২ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। গত ২৫ মার্চ বাদলঘাটা স্কুলবাজারে উভয়পক্ষ বসে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিনামা তৈরি করার সময় সুমন তার বাহিনীসহ সেখানে হানা দিয়ে ২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে সুমন ও তার বাহিনীর তাণ্ডবে বাদলঘাটা গ্রামের আব্দুল জলিলের পুরো পরিবার ১০ মাস ধরে এলাকাছাড়া রয়েছেন। লুটপাট করা হয়েছে ওই পরিবারের ধান, চাল, সরিষা, মরিচ, সোনা, নগদ টাকাসহ একটি গরু। পুরো পরিবারটি এখন কোঁচড়া দক্ষিণপাড়া গ্রামে বাবুল হোসেন সরদারের বাড়িতে অবস্থান করছেন। এ পরিবারের সদস্য শফিকুল ইসলামকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মাঠ থেকে ধরে নিয়ে সৌরভের গভীর নলকূপের ঘরে আটক রেখে ব্যাপক নির্যাতন করে। এসময় কয়েকটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে নেয়া হয়। এ পরিবারের ৭ বিঘা জমি জবরদখল করে বোরো ধান রোপণ করেছে সুমন ও তার বাহিনী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সুমন ও তার বাহিনীর সদস্যরা দিন-দুপুরে এলাকার লোকজনের হাঁস ধরে জবাই করে পিকনিক খায় ও উল্লাস করে। তাদের ভয়ে এলাকার সুন্দরী নারী ও স্কুল শিক্ষার্থীরা বাইরে যেতে পারেন না। সুমনসহ তার বাহিনীর ৩ সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ায় এলাকায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। অবিলম্বে অন্য সহযোগীদেরও গ্রেপ্তারের দাবি জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে মান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ শাহিনুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে দুটি মামলায় সুমনসহ তার ৩ সহযোগী লালু মন্ডল, সুলতান ও মাইনুলকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প। এ বাহিনীর অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
মতিহার বার্তা / ইএবি
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.