অনলাইন ডেস্ক: বিদ্যালয়ে একসঙ্গে এক বেঞ্চে বসে ক্লাস করে ওরা। খেলাধুলাও একসঙ্গে। হোটেলে খাবার খাওয়ার বেলায় শুধু বৈষম্য। একদল শিক্ষার্থীকে হোটেলের ভেতর চেয়ার-টেবিলে বসে খেতে দেওয়া হয়।
অন্য দলকে বসতে দেওয়া হয় হোটেলের বাইরে পাতা বেঞ্চে।যাদের হোটেলের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হয় না, তারা হরিজন সম্প্রদায়ের শিশু শিক্ষার্থী। এই যুগেও সামাজিকভাবে এমন বৈষম্য তৈরি করে রেখেছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কয়েকটি হোটেল মালিক। অন্য ক্রেতাদের আপত্তিতে তাঁরা এটি করছেন বলে দাবি মালিকদের।
বৈষম্যের শিকার এই শিশু শিক্ষার্থীরা কুলাউড়া পৌর শহরের পরিনগর রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে বসবাস করে। তারা শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। ওই শিক্ষার্থীরা জানায়, স্কুলের বন্ধুরা যখন হোটেলে বসে খাবার খায়, টিফিন করে, তখন তাদের হোটেলের বাইরের বেঞ্চে বসিয়ে কাগজে খাবার দেওয়া হয়। প্লেট পর্যন্ত দেওয়া হয় না।
গত বৃহস্পতিবার পৌর শহরের ইস্টার্ন ও পাকশী রেস্টুরেন্টে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার সঙ্গে। হাজি হারিস আলী, রাজুম আলী রাজু, আজিজুর রহমান রুকন, মাসুদ বক্স, রেদওয়ান বক্স রাহাত নামের কয়েকজন ভোক্তা স্বীকার করেন যে হরিজনদের ভেতরে বসতে দিতে তাঁদের আপত্তি আছে। এই যুগেও এ রকম বৈষম্য করার কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, হরিজনরা মদ পান করে। তবে শিশু শিক্ষার্থীদের বাধা কোথায়—জানতে চাইলে তাঁরা এর সদুত্তর দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের কুলাউড়া শাখার সভাপতি মত্লা বাসপর বলেন, ‘আমরা হরিজন সম্প্রদায় বলে কুলাউড়ার হোটেলগুলোতে আমাদের তো খেতে দেওয়া হয় না। এখন দেখি আমাদের শিশুদের সঙ্গেও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। ’
কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক ও রুদ্রবীণা সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রজত কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, হরিজন সম্প্রদায় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মানুষ সভ্যতার ধারাবাহিকতায় অগ্রসর হচ্ছে, বিভিন্ন কাজের মতো তাদের কাজও একটি দায়িত্ব। তারা তা আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে। হোটেল, রেস্টুরেন্টে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি মানবতাবিরোধী ও অযৌক্তিক। এ রকম অনেক কাজ অনেকেই করে, যা এমনতর অস্পৃশ্য; কিন্তু তাদের চেনা যায় না। তারাও আপনার-আমার সন্তানের মতোই সন্তান। ’
হরিজন সম্প্রদায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ এনে এর প্রতিকার চেয়ে গত ২৩ অক্টোবর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। ওই অভিযোগ দেওয়ার এক মাসেও এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
ইস্টার্ন রেস্ট্ররেন্টের মালিক মো. শাহাজান খানের দাবি, হরিজনরা হোটেলের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তা সঠিক নয়। তাদের নিয়মিত হোটেল থেকে পার্সেল বা হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়। আর শিক্ষার্থীরা স্কুল টিফিন বা ছুটি শেষে শুধু নাশতা পার্সেল হিসেবে নিয়ে যায়।
কুলাউড়া হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. লোকমান মিয়া বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে যদি স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের হোটেলে খাবার না দেওয়া হয় তবে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ’
কুলাউড়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম আতিকুর রহমান আখই বলেন, ‘হরিজনরা আমাদের সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা কোনো সময়ই তাদের আলাদা করে দেখিনি। প্রকৃতপক্ষে ৯০ শতাংশ ভোক্তার আপত্তির কারণে এবং বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এড়াতে তাদের নিরুৎসাহ করা হয়। ’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমি একটি হোটেল পরিদর্শনও করেছি ও হোটেল মালিককে বলেছি সংবিধান বা আইনের কোনো জায়গায় কি এমন কথা আছে যে হরিজন বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে একত্রে বসে খাওয়া যাবে না। তাই সবাইকে বলেছি এভাবে কোনো জাতিকে বৈষম্য করা যাবে না। ’
এ বিষয়ে পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী সমিতি ও হোটেল মালিক সমিতির নেতারা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি ন্যায়সংগত একটি সমাধানের জন্য ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। শিগগিরই সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধান করা হবে। ’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, ‘হরিজনদের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়ার পর হোটেল মালিকদের ডেকে নির্দেশনা দিয়েছি, কাউকে হেয় না করে সুন্দর পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য। ’
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.