অনলাইন ডেস্ক: জনপ্রিয় মিউজিক অ্যাপ টিকটক ভিডিওর নেশায় আসক্ত এ সময়ের তরুণ-তরুণীরা। আর এই অ্যাপ ব্যবহার করে দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার আশায় তরুণীরা পা দিচ্ছে পাচারকারী চক্রের ফাদে। সম্প্রতি এই পাচার চক্রের শীকার এক তরুণী ভারত থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ভারত থেকে দেশে ফিরে ওই তরুণী পুলিশকে জানিয়েছেন, সেখানে অবস্থান করার সময় তিনি আরো অনেক বাংলাদেশি তরুণীকে দেখেছেন। যারা বিভিন্ন সময়ে এই চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়েছেন।

এছাড়া গ্রেপ্তার মেহেদী হাসান বাবু পাচারের শিকার মামলার বাদী তরুণীসহ ১ হাজারের বেশি নারী পাচার করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। বুধবার ঢাকা দুপুরে শ্যামলীর নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ এসব কথা বলেন।

পুলিশ জানায়, মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো, মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের। গতকাল রাতে তাদের সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এসময় তাদের কাছ থেকে থেকে পাচারের কাজে ব্যবহৃত ২টি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মোবাইল ও একটি ভারতীয় সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। যারা ভারতে প্রায় এক হাজার নারীকে পাচারে সীমান্ত পার হতে সরাসরি সহায়তা করেছেন।

পুলিশ আরো জানায়, ২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ভুক্তভোগী ওই তরুণীর। কখনো টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে, আবার কখনো ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন হৃদয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট করেন হৃদয়। পরে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করা হয়।

এছাড়াও এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এই তরুণীকে চক্রের অন্যান্যদের সহায়তায় সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেন হৃদয়।

ওই তরুণীর দেয়া তথ্যমতে পুলিশ জানায়, ভারতে পাচারের পর তাকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় ভারতে এ চক্রের দ্বারা পাচারকৃত আরো কয়েকজন বাংলাদেশি ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান। যাদেরকে সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পরই ওই ভুক্তভোগী তরুণীকে চেন্নাইয়ের অয়ো (Oyo) হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতন করা হয় তাকে। সেখানে সামান্যতম দয়া কিংবা করুণা দেখায়নি চক্রের সদস্যরা।

কৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য বা পরিচিতদের পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল এই ভুক্তভোগী তরুণীকে। পাচারকারী চক্রের হাত থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা ওই কিশোরীর করা মামলার এজাহারে ও তদন্তে উঠে এসেছে লোমহর্ষক বর্ণনা, যে করুণ কাহিনী কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।

তেজগাঁও বিভাগের এই উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, ৭-৮ বছর ধরে পাচারে জড়িত মেহেদী হাসান বাবুর মোবাইল ও ডায়েরিতে টিকটক হৃদয়, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। তার ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ভিকটিমের আধার কার্ড নম্বর ও ভারতে পাচারকৃত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিকটিমের নাম ও মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।

অপর গ্রেপ্তার মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মিত কক্ষে ভিকটিমদের অবস্থানে সহায়তার পাশাপাশি তাদেরকে মোটরসাইকেল যোগে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

ডিসি শহীদুল্লাহ বলেন, টিকটকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এই পাচারকেন্দ্রিক অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। উঠতি বয়সী কিশোরী তরুণীদেরকে মডেল বা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে পাচার করছে একটি চক্র। এজন্য আমরা টিকটককে আমরা নেগেটিভলি দেখছি। টিকটককেন্দ্রিক অপচেষ্টা বন্ধে আমরা জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে যায়। তাদের কাছে ভিসা-পাসপোর্ট বা কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র থাকে না। এরপর চক্রের ভারতীয়দের সহায়তায় সে দেশের আধার কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। যে কার্ড ব্যবহার করে তারা ভারতে মুভমেন্ট করে থাকেন।

পালিয়ে আসা বাকি দুইজন ভারত ফেরত ভুক্তভোগীর নাম-ঠিকানা জেনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে পুলিশ।

মতিহার বার্তা / ইএবি