ধর্ম ডেস্ক: মক্কার পবিত্র গ্র্যান্ড মসজিদে প্রতিদিন কাবাঘর তাওয়াফ করেন লাখ লাখ মুসল্লি। তীব্র তাপমাত্রার মধ্যেও মসজিদের মেঝে প্রদক্ষিণকালে পায়ে ঠাণ্ডা অনুভূত হয় সবার। এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই আগত মুসল্লিদের। অনেকের ধারণা, মেঝের নিচে থাকা ঠাণ্ডা পানির পাইপ বা তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে; যার কারণে এমন শীতলতা অনুভব হয়। তবে এসব ধারণা মোটেও সঠিক নয় বলে জানিয়েছে মসজিদ পরিচালনা পর্ষদ। মূলত মসজিদের কিছু দুর্লভ নির্মাণসামগ্রী এই রহস্য তৈরি করেছে।
প্রচণ্ড রোদেও কাবা চত্বর ঠাণ্ডা থাকে কেন
সম্প্রতি আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে কাবাঘরের মেঝের শীতলতার রহস্য তুলে ধরা হয়। পবিত্র মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সূত্রে তাতে বলা হয়, মাতাফে (তাওয়াফের স্থান) এক ধরনের থাসোস মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে। প্রচণ্ড তাপমাত্রার মধ্যেও শীতল থাকার এটিই প্রধান কারণ। মনে করা হয়, এখানেই বিশ্বের বৃহত্তম মার্বেলের প্রয়োগ হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৭৮ মোতাবেক ১৩৯৮ হিজরি সনে সৌদি বাদশাহ খালিদের নির্দেশে পবিত্র মসজিদুল হারামের মাতাফ সম্প্রসারণকালে প্রথমবার এর মেঝেতে থাসোস মার্বেল লাগানো হয়। পবিত্র মসজিদে ব্যবহৃত মার্বেলের পুরুত্ব পাঁচ সেন্টিমিটার। এর বৈশিষ্ট্য হলো, তা রাতের বেলা ছিদ্রের মাধ্যমে মুহূর্তেই আর্দ্রতা শোষণ করে এবং দিনের বেলা রাতের শোষিত আর্দ্রতা বের করে। তা ছাড়া সূর্যের রশ্মিকে প্রতিফলিত করে দিনের বেলা মেঝের তাপমাত্রা কমাতে সহায়তা করে। ফলে তপ্ত রোদের মধ্যেও সব সময় মসজিদের মেঝে শীতল থাকে, যা অন্য কোনো গ্রানাইট ও মার্বেল পাথরে নেই। অনেক বছর ধরে সৌদি আরব বিখ্যাত গ্রিক থাসোস মার্বেল আমদানি করছে। সৌদি আরবের বেসরকারি কারখানায় প্রযুক্তিবিদদের তত্ত্বাবধানে বিশাল পাথর থেকে বিভিন্ন সাইজে তা কাটা হয়।
মসজিদ পরিচালনাকারী জেনারেল প্রেসিডেন্সির প্রকৌশলী ফারেস আল-সায়েদি জানান, গ্রীষ্মের সময়ে মক্কায় ৫০-৫৫ সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। পবিত্র মসজিদে মুসল্লিদের খালি পায়ে প্রবেশ করতে হয়। তাই আল্লাহর ঘরের অতিথিদের উচ্চ তাপমাত্রা থেকে সুরক্ষিত রেখে স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ তৈরিতে মসজিদের মেঝেতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের থাসোস পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। ৪০ জনের বেশি প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ সার্বক্ষণিকভাবে এসব পাথর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন।
২০২১ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক জার্নাল কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালসের সমীক্ষায় বলা হয়, পাথরগুলোর থার্মোফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য হলো, তা সৌর নিরোধক তাপকে প্রতিফলিত করে এবং ছড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, থাসোস মার্বেলের মধ্যে উচ্চ সৌর প্রতিফলন এবং চুনাপাথরের তুলনায় তাপ পরিবাহিতার উচ্চ হার রয়েছে। সাধারণত ইসলামী স্থাপত্যগুলোতে চুনাপাথরের বহুল ব্যবহার রয়েছে। সার্বিকভাবে পাথরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য গ্রীষ্মের সময় শীতল তাপ বজায় রাখতে সক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে। একই সময়ে দুর্লভ মার্বেলের ব্যবহার মসজিদের শৈল্পিক পরিবেশকে আরো দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্লভ মার্বেলগুলোর একটি থাসোস মার্বেল। স্নো হোয়াইট মার্বেল নামেও পরিচিত পাথরটি সবচেয়ে শক্ত প্রাকৃতিক পাথরগুলোর অন্যতম। গ্রিসে স্ফটিক সাদা রঙের এই পাথরের বহুল ব্যবহার রয়েছে। অ্যামফিপোলিসের প্রাচীন মেসিডোনিয়ান সমাধি, ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়াসহ ইতিহাসের সেরা স্থাপনাগুলোর দেয়াল ও মেঝে এই পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়। বিলাসবহুল ভিলা ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় এর ব্যবহার দেখা গেলেও তা মোটেও সস্তা নয়। ভারতীয় মার্বেল সরবরাহকারী আরএমএস মার্বেল অনুসারে, এর দাম প্রতি বর্গমিটারে ২৫০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার হতে পারে।
মার্বেলটি এজিয়ান সাগরের কাভালার নিকটস্থ পূর্ব গ্রিক দ্বীপ থাসোস থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে স্থানটি মূল্যবান পাথর সংগ্রহের স্থান হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া মার্বেল আবিষ্কার এবং যুগে যুগে এর নিত্যনতুন ব্যবহার উদ্ভাবনে গ্রিকরা ছিল অগ্রগামী।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.