মতিহার বার্তা ডেস্ক: ঘাটাইলে কাল্পনিক প্রকল্প ও ভুয়া মাস্টাররোল তৈরি করে অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজনের নামে ৪০ দিন কর্মসূচির বরাদ্দকৃত অর্থের ৪ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ সিন্ডিকেটে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এবং দু’জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কিন্তু পিআইও গেল বছর ১৭ অক্টোবর মাসিক সমন্বয় সভায় ত্রাণ বিভাগ কর্তৃক ৪০ দিন প্রকল্পের নামে প্রথম পর্বে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৪ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে বলে জানায়। আবার চলতি বছর ২০ মার্চে একইভাবে ত্রাণ বিভাগ কর্তৃক দ্বিতীয় পর্বের জন্যও প্রথম পর্বের মতো সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ত্রাণ বিভাগের উল্লিখিত অঙ্কের কোনো অর্থ ঘাটাইল উপজেলা হিসাব শাখায় জমা হয়নি। বরাদ্দের আসল অঙ্ককে আড়াল করে দুর্ভিসন্ধিমূলক মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রকল্প শুরুর আগেই ২৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪৭৮ টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে লাপাত্তা হওয়ার ঘটনা।
অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ১৩৬টি প্রকল্পে উপকারভোগী নিয়োগ দেয়া হয় ৫ হাজার ৮২৬ জন। ব্যাংক থেকে বিল উত্তোলন করা হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ থেকে ৩ মাস পর।
এদিকে সরজমিনে ১৪টি ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে লুটপাটের ভয়াবহতার চিত্র উঠে আসে। অনেকেই জানেন না এ বছর ৪০ দিন প্রকল্পের কোনো কাজ আছে কি না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মাঝে মধ্যে ২-৪ জন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। তবে কোথাও প্রকল্পের কোনো সাইনবোর্ড চোখে পড়ে নাই।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, জামুরিয়া ইউনিয়নে ৪০ দিন কর্মসূচির কোনো শ্রমিক একদিনের জন্যও কাজ করে নাই। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, আমি যে কাজ করেছিলাম সেগুলো দেখিয়ে সম্প্রতি প্রকল্পের বিল তোলা হয়।
ঘাটাইল ইউনিয়নে কয়েকদিন পরিদর্শনে গিয়ে শুধু দেলোয়ার হোসেন লেবু মেম্বারের কিছু শ্রমিক ছাড়া এ ইউনিয়নে ৪০ দিন কাজের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবে দিঘলকান্দি, লোকেরপাড়া, দিগড়, দেওপাড়া, ধলাপাড়া, রসুলপুর, সাগরদীঘি, লক্ষিন্দর, সন্ধানপুর প্রভৃতি ইউনিয়নে প্রকল্পের কোনো সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। কাজেরও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবে কাল্পনিক প্রকল্প দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়েছে কাজের শতকরা ৮০ ভাগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইউপি সচিব আক্ষেপ করে বলেন, প্রকল্পের ভুয়া মাস্টাররোল করতে হয় আমাগো আর বিলের প্রায় সম্পূর্ণ টাকা যায় পিআইও আর ইউএনও’র পকেটে। আমরা একেবারে জিম্মি হয়ে পড়েছি। কাগজ-কলমে ৮০ শতাংশ কাজ দেখিয়ে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এ সিন্ডিকেট। এ জন্য এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তাও জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় এক ইউপি মেম্বার জানান, এখানে কর্মসূচির কোনো কাজ না হলেও স্থানীয় শাখার ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে আঁতাত করে পুরো বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা জানান, ‘এমদাদের বাড়ি থেকে নিজামের বাড়ি’ নামক ৪০ দিন প্রকল্পে ৫৩ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা, সেখানে কাজ করছে ৯-১২ জন। তাও হয়েছে সর্বোচ্চ ৭-৮ দিন। একই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেনও একই কথা বললেন।
জানতে চাইলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, আগে প্রকল্প পরিদর্শন করছি। তখন কাজ হয়েছে। আমার মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ বছর আগে থেকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুই বছরের মধ্য কিছু করি নাই। ওই সময় আমার বাসায় ফাইল নিয়ে গেছে, আমি শুধু স্বাক্ষর দিয়ে দিছি।
পুরো উপজেলায় ৪০ দিন প্রকল্পের ৫ ভাগ কাজও হয়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে পিআইও এনামুল হক বলেন, তাহলে কি চাকরি থাকে। এক সাংবাদিক ২০ ভাগ কাজ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি তার কথায় সম্মতি দেন। এছাড়া আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও মো. কামরুল ইসলাম বলেন, আমিও ঘুরে দেখেছি শ্রমিকের উপস্থিতি কম ছিল। এজন্য আমি ১০ শতাংশ কেটে দিয়েছি।
শ্রমিক মজুরি সপ্তাহের বিল সপ্তাহে দেয়া হয় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তাহলে আর কোনো কাজ করতে হবে না। শুধু বিল নিয়েই থাকতে হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যা কাজ হয়েছিল তা বন্যায় ধুয়ে গেছে। এটা আমার কথা না, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের কথা।’
মতিহার বার্তা ডট কম – ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.