স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউক) নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত আসামী সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামান। তিনি মানবিক বিভাগে পড়েও বনেছেন রাউকের সহকারী প্রকৌশলী। শুধু তাই নয়, তিনি ২০০৪ সালে রাউকের নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও অর্থ ও ক্ষমতার বলে অবৈধভাবে নিয়োগের কারণে ২০১২ সালের ১৪ জানুয়ারি দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই মামলার ২০১৮ সালের চার্জশিটভূক্ত আসামী তিনি। ফেল করেও এখনও বহাল তবিয়তে রাউকে স্বপদে চাকরি করছেন মানবিক বিভাগ থেকে পড়া শেখ কামরুজ্জামান।
এদিকে, রাউকের সহকারী প্রকৌশলী পদে তার অবৈধ নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। তার নিয়োগ ও অনিয়মের চর্চা রাউক তথা নগরজুড়ে এখন হট টকে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিবেদকের কাছে রাউকের সহকারী প্রকৌশলী শেখ কারুজ্জামানের দুদক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠি, আদালত ও থানার নথিসহ তার অবৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যদি হাতে এসেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শেখ কামরুজ্জামান ১৯৯৩ সালে মানবিক বিভাগ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাস করেন। পরে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন। অথচ সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরির লিখিত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তারা সকলেই ছিলেন বিএসসি (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রিধারী যোগ্য প্রার্থী।
জানা গেছে, ওই পরীক্ষায় সুলতান মো. সাজ্জাদ, মোহা. কাজেম উদ্দিন, মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ, মো. শাহিন ইবনে রফিক ও এএমএম রাশেদুর রহমান পর্যায়ক্রমে উর্ত্তীণের তালিকায় অবস্থান করেন। অকৃতকার্য হন শেখ কামরুজ্জামান। রাউক কর্তৃপক্ষ ‘অনিবার্য’ কারণ দেখিয়ে ২০০৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর উক্ত লিখিত পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করেন। এরপর মৌখিক পরীক্ষায় বিএসসি ডিগ্রীধারী সকল কৃতকার্যদের বাদ দিয়ে সহকরী প্রকৌশলী পদে শেখ কামরুজ্জামানকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়।
নিয়োগ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৪ সালের ১৬ আগস্ট ১০টি পদের বিপরীতে ১১ জন জনবল নিয়োগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সহকারী প্রকৌশলী পদের শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য চাওয়া হয়- ‘ফিজিক্যাল প্লানিং/টাউন প্লানিং/আরবান এন্ড রিজিওনাল প্লানিং/সিভিল ডিজাইন/ইলেকট্রিক এ মাষ্টার ডিগ্রি অথবা স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অথবা সসিওলজি/ভূগোল/অর্থনীতিতে মাষ্টার ডিগ্রী এবং তৎসহ এমপিপি ডিগ্রী থাকিতে হইবে অথবা স্থাপত্য বিদ্যা পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী অথবা সম্মানের ডিগ্রীসহ ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকিতে হইবে’। একই সাথে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৫নং শর্তে উল্লেখ করা হয়, ক্রমিক ১ থেকে ৭ নম্বর পদগুলির জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীকে বাছাই করা হবে। এসমস্ত শর্তাদি থাকার পরও শেখ কামরুজ্জামান সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে আবেদন করেন।
পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, লিখিত পরীক্ষায় পূর্ণমাণ ছিল ১০০। আর নূন্যতম পাস নম্বর ছিল ৩৩। এরমধ্যে শেখ কামরুজ্জামান লিখিত পরীক্ষায় ২৪ নম্বর পেয়ে অকৃতকার্য হন তিনি। পরে লিখিত পরীক্ষা বাতিল করে অবৈধভাবে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয় কামরুজ্জামানকে। মৌখিক পরীক্ষায় কামরুজ্জামানকে সর্বোচ্চ ৬৬ নম্বর দিয়ে কৃতকার্য দেখানো হয়। ৭০% ছাড়পত্রের বিপরীতে তাকে সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে বাদ পড়েন লিখিত পরীক্ষায় সাড়ে ৫৫ নম্বর প্রাপ্ত প্রথম স্থানের সুলতান মো. সাজ্জাদ হোসেন, দ্বিতীয় ৪৪ নম্বর প্রাপ্ত মো. কাজেম উদ্দীনসহ অন্যান্য যোগ্য প্রার্থীরা।
পর্যালোচনায় আরও জানা যায়, ওই নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হিসেবে আরডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব হিসেবে তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। তাদের বিধিবর্হিভূত নিয়োগ কার্যের জন্য ২০০৫ সালের ২৭ জুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আকতারুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। এখানে ৭০% ছাড়পত্রের বিপরীতে নিয়োগ সহ রাউকের অন্যান্য দূর্নীতির তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমাদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাউকের এক কর্মচারী জানান, নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে মর্মে নিয়োগবঞ্চিতরা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেন। এনিয়ে দুদক তদন্ত শুরু কওে এবং প্রাথমিকভাবে এর সত্যতা পায়। পরবর্তীতে তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই দুদকের রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক আব্দুল করিম শাহমখদুম থানায় মামলা করেন। এরপর দীর্ঘ আট বছর তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক ফরিদুর রহমান আরডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রব জোয়ার্দার ও সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জানকে অভিযুক্ত করে রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। পরে তিন অভিযুক্ত সুপ্রীমকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। ওই পিটিশনে তারা চার সপ্তাহের স্টে অর্ডার প্রাপ্ত হন। তবে পরবর্তীতে সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান আর কোনো স্টে অর্ডার পাননি। ফলে তিনি সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিল করেন যার শুনানি এখন পর্যন্ত হয়নি।
তবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী চার্জশীটভুক্ত আসামির বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের বিধান থাকলেও আরডিএ কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেননি। বিবাদির আপিলকে পুঁজি করে বর্তমান চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযুক্ত শেখ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলেও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। রাউক কর্তৃপক্ষের এমন অনীহাকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই রহস্যজনক বলে মনে করছেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৫ অধিশাখার ২০১২ সালের এক পরিপত্র মোতাবেক যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ করার কথা। একইসাথে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে উল্লেখ করে ২০১৯ সালে আরেকটি চিঠি প্রেরণ করেছে। কিন্তু গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, আদালতের নির্দেশনা ও দুদকের চার্জশীটের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে গোপন রাখা হয়েছে। এত কিছু সত্তেও শেখ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ বা তাকে সাময়িক সাসপেন্ড করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেদককে শেখ কারুজ্জামান বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ আমাকে দেখেই নিয়োগ দিয়েছেন, না দেখে তো আর নিয়োগ দেয় নাই। দেখে নিয়োগ দিলে অবৈধ হলো কিভাবে?’
তবে নিয়োগ নিয়ে কর্তৃপক্ষের অনিয়ম ও আপনার নিয়োগ নিয়ে দুদকের মামলার কপি আমার কাছে রয়েছে। এবিষয়ে আপনার আত্মপক্ষ সমর্থনে কি বলতে চান? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাতে যখন কাগজ আছে তখন যা ইচ্ছে তা-ই লেখেন। আমার কিছু বলার নেই।’ এই বলেই ফোন কেটে দেন।
শেখ কামরুজ্জামান মানবিকের ছাত্র হয়েও কিভাবে প্রকৌশলী পদে দেড় যুগ ধরে চাকরি করছেন জানতে চেয়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউক) চেয়ারম্যান মো. আনওয়ার হোসেনকে তার মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হয়। পরবর্তীতে, ‘শেখ কামরুজ্জামানের নিয়োগ বিষয়ে কথা বলতে চাই’ জানিয়ে একটি ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করি। কিন্তু তাতেও তিনি কোন সাড়া দেননি।
মতিহার বার্তা / ইএবি
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.