যেসব কারণে ইবাদত করে তৃপ্তি মেলে না

যেসব কারণে ইবাদত করে তৃপ্তি মেলে না

ইসলামীক ডেস্ক অর্থের প্রাচুর্য, সুস্বাদু খাবার, নরম বিছানা ও দৃষ্টিনন্দন বাড়ি যেমন মানুষের মন উত্ফুল্ল করে, তেমনি আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর ইবাদত-আরাধনা, তাঁর জন্য আত্মনিবেদন মুমিন হৃদয় তৃপ্ত করে। মুমিন যখন তার স্রষ্টার স্মরণে রত হয় এবং তাঁর সিজদায় নত হয়, তখন সে পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যায়, তার হৃদয় এক অপার্থিব তৃপ্তিতে ভরে যায়। হাদিসের ভাষায় এই তৃপ্তি ও আনন্দের নাম ‘হালাওয়াতুল ঈমান’ বা ঈমানের মিষ্টতা এবং ‘তা’মুল ঈমান’ তথা ঈমানের স্বাদ। সাধক আলেমরা বলেন, ঈমানের স্বাদ ইবাদতের তৃপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ঈমানের পূর্ণতার মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে তৃপ্তি ও স্বাদ খুঁজে পায়। আর এই তৃপ্তি পার্থিব জীবনে মুমিনের সর্বোত্তম প্রাপ্তি ও উপহার। যার ঈমানের দৃঢ়তা যত বেশি, সে ঈমানের মিষ্টতা ও ইবাদতের স্বাদ তত বেশি লাভ করে।

হাদিসের বর্ণনায় ঈমানের স্বাদ

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে—ক. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তার কাছে সব কিছু থেকে বেশি প্রিয় হওয়া, খ. কাউকে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা, গ. কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৬)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘সেই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভ করেছে, যে আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে, ইসলামকে দ্বিন হিসেবে এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৬২৩)

ঈমানের স্বাদের ব্যাখ্যা

‘হালাওয়াতুল ঈমান’ বা ঈমানের স্বাদের ব্যাখ্যা আলেমরা ভিন্ন ভিন্নভাবে দিয়েছেন। যার মূল কথা আল্লাহর স্মরণ ও আনুগত্যে তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া। যেমনটি কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)

ইমাম নববী (রহ.) ‘ঈমানের স্বাদে’র ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ঈমানের স্বাদ হলো আল্লাহর আনুগত্যে স্বাদ পাওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি লাভের জন্য কষ্ট সহ্য করা এবং পার্থিব জীবনের ওপর তাকে (আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি) অগ্রাধিকার দেওয়া।’ (তুহফাতুল আহওয়াজি : ৭/৩৭৩)

ঈমানের স্বাদ যেসব ইবাদতে বেশি অনুভূত হয়

মুমিন তার ‘ঈমানের স্বাদ’ সব ইবাদত ও আনুগত্যে খুঁজে পায়। তবে যেসব ইবাদতে আল্লাহর নৈকট্য বেশি লাভ হয়, সেসব ইবাদতে ঈমানের স্বাদ বেশি অনুভূত হয়। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘মানুষ তিন বিষয়ের স্বাদ হারিয়ে ফেলেছে : নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির (আল্লাহর স্মরণ)। যদি তোমরা এসব ইবাদতে স্বাদ খুঁজে পাও তবে তা অব্যাহত রাখো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো। আর যদি না পাও তবে বুঝে নাও তোমার জন্য দরজা বন্ধ হয়ে আছে।’ (নাশআতুল ফিকরিল ফালসাফি ফিল ইসলাম : ৩/১৭৫)

ইবাদতে অতৃপ্তি পাপের শাস্তি

যখন কোনো বান্দা আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপে লিপ্ত হয়, তখন তার অন্তরে ঈমানের নূর (জ্যোতি) কমে যায়। ফলে সে ইবাদতের স্বাদ হারায়। বান্দা যত বেশি পাপে নিমজ্জিত হবে সে ঈমান ও ইবাদতের স্বাদ তত হারাবে। আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘পাপের অনিবার্য পরিণতি হলো দুশ্চিন্তা, মানসিক কষ্ট, হৃদয়ের সংকীর্ণতা ও মন্দ আচরণ, অন্তরের অন্ধকার ও কাঠিন্য এবং ইবাদতের স্বাদ হারিয়ে ফেলা।’ আর আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘পাপের একটি শাস্তি হলো অন্তরের মৃত্যু এবং জিকির, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও মোনাজাতে স্বাদ হারিয়ে ফেলা।’ (ইতহাফুল আশিকিন, পৃষ্ঠা : ৪৩৭)

আহমদ ইবনে হারব (রহ.) বলেন, ‘আমি ৫০ বছর ইবাদত করেছি, কিন্তু তার স্বাদ পাই যতক্ষণ না তিনটি কাজ পরিহার করেছি। তা হলো, মানুষের সন্তুষ্টির প্রত্যাশা—ফলে আমি সত্য প্রকাশে সক্ষম হয়েছি, পাপীদের সংস্রব—ফলে আমি পুণ্যবানদের সংস্রব পেয়েছি এবং দুনিয়ার স্বাদ-আহ্লাদ—ফলে আমি পরকালের স্বাদ পেয়েছি।’ (সিয়ারু আ’লামুন নুবালা, পৃষ্ঠা : ৭৯৪)

তাওবায় খোলে বন্ধ দুয়ার

অব্যাহত পাপের কারণে মানুষের অন্তরে যে অন্ধকার নেমে আসে এবং ঈমান ও ইবাদতের স্বাদ লাভের যে পথ বন্ধ হয়—তা তাওবার মাধ্যমে উন্মুক্ত হয়। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘যখন কেউ দেখে তার হৃদয় প্রশস্ত হচ্ছে না, সে ঈমানের স্বাদ পাচ্ছে না এবং হেদায়েতের নূর খুঁজে পাচ্ছে না, তখন সে যেন বেশি বেশি তাওবা করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় এবং তা অর্জনের সব ধরনের চেষ্টা করে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘যে আমার ব্যাপারে চেষ্টা করবে আমি অবশ্যই তার জন্য আমার পথগুলো খুলে দেব।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)। সে প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহর নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করবে এবং সৎপথে অটল থাকবে—আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর আশ্রয় কামনা করবে। (আল ফাতাওয়াল কুবরা : ৫/৬২)

ইবাদতের স্বাদ পেতে করণীয়

আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান, তাঁর ইবাদতে নিষ্ঠা ও জীবনের সর্বত্র দ্বিনের নিঃশর্ত আনুগত্য ছাড়া মানুষ ইবাদতের পরিপূর্ণ স্বাদ লাভ করতে পারে না—এক কথায় যাকে আল্লাহর একনিষ্ঠ দাসত্ব বলা যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে, নামাজ কায়েম করতে ও জাকাত দিতে; আর এটাই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা : বায়্যিনাহ, আয়াত : ৫)

ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মানুষের অন্তরে অপূর্ণতা রয়েছে—যা আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া পূর্ণ হয় না, তাতে হিংস্রতা রয়েছে—যা একান্তে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা ছাড়া দূর হয় না, তাতে দুশ্চিন্তা রয়েছে—যা আল্লাহর পরিচয় লাভ ও তাঁর হকগুলো আদায় করা ছাড়া দূর হয় না, তাতে অস্থিরতা রয়েছে—যা থেকে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাওয়া ও তাতে স্থির থাকা ছাড়া মুক্তি পাওয়া যায় না, তাতে আক্ষেপের আগুন আছে—যা তার আদেশ, নিষেধ, সিদ্ধান্ত ও মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্তের (ভাগ্যের) ওপর সন্তুষ্টি ছাড়া নেভান যায় না।’ (তা’তিরুল আনফাস মিন হাদিসিল ইখলাস, পৃষ্ঠা-৮২)

অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে ঈমানের সঙ্গে ভালো কাজ করবে আমি তাকে উত্তম জীবনযাপন করাব।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯৭)

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আল্লাহ তাকে ভালো কাজের তাওফিক দেবেন এবং তার অন্তরকে প্রশস্ত করবেন (তাতে তৃপ্তি দেবেন)।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

মতিহার বার্তা ডট কম –১৯ মার্চ, ২০২০

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply