হাফিজুল হক, সাপাহার নওগাঁ প্রতিনিধি: সাপাহার বাসী ও প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের ১৩ সেপ্টেম্বর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরনে শহীদ দিবস হিসাবে পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিকট জোর দাবি ও সাপাহার মুক্তিযোদ্ধা “কমান্ট”সংসদের নিকট দাবী জানিয়েছে। এই ১৩ সেপ্টেম্বর নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলা বাসীর জন্য এক ভয়াবহ ও শোকাবহ্ দিন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দিনে সাপাহারকে শত্রু মুক্ত করতে গিয়ে এলাকার ২১বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাই আজো বছর ঘুরে এই ১৩সেপ্টেম্বর এলে সাপাহারের অনেক মুক্তিকামী মানুষ ও সন্তান হারা মা-বাবা’ ভাই হারা ভাই-বোন তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান ও ভাইকে ফিরিয়ে পেতে দিনটিকে স্মরন করে অঝোরে তাদের চোখের পানি ফেলেন ও ডুকরে ডুকরে কাঁদেন।
এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী সে দিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম জাহিদুল ইসলাম, মনছুর আলী, আঃ রাজ্জাক সহ একাধীক মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকার প্রবীন ব্যক্তিদের নিকট থেকে জানা যায়, দেশে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে তৎকালিন সাপাহার হাইস্কুল বর্তমান পাইলট স্কুল মাঠ ও পার্শ্ববর্তী একটি পুকুর পাড়ে পাক-সেনারা একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরী করে। আর সেখান থেকেই প্রতিদিন তারা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে অসহায় মানুষের ধনসম্পদ লুট পাট মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করে এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পাকিস্থানী হানাদার লেঃ শওকত আলীর অধীনস্থ সাপাহারের সেই শক্তিশালী ক্যাম্পটিকে উৎখাত করে নর পিচাশদের কবল থেকে অসহায় নিরস্ত্র মানুষকে রক্ষা করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় সাহসী কিছু মুক্তিযোদ্ধার দল। যুদ্ধের প্রায় ৬মাস পর সেপ্টেম্বর মাসে সাপাহারকে পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোষরদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এলাকার ও পার্শ্ববর্তী মহাদেবপুর উপজেলার ৮০জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকে।
একদিন সুযোগ বুঝে ১৩ সেপ্টেম্বর তারা মুক্তিবাহিনীর মেজর রাজবীর সিংয়ের আদেশক্রমে ও ইপিআর এর হাবিলদার আহম্মদ উল্লাহর নেতেৃত্বে ৮০জনের ওই সু-সজ্জিত দলটিকে তিনটি উপ দলে বিভক্ত করে। এর পর একটি দলকে সাপাহার-পত্নীতলা সড়কের মধইল ব্রীজে মাইন বসানোর কাজে নিয়োজিত করে যাতে নজিপুর হতে নতুন কোন শত্রু সেনা সাপাহারে প্রবেশ করতে না পারে। অপর দলটিকে সার্বক্ষনিক টহল কাজে নিয়োজিত রাখে আর মুল দলটি শত্রু সেনার ঘাঁটিকে আঘাত করার জন্য কাছা কাছি একটি ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের হাজারো সর্তকর্তা ও নিশ্চিদ্রতার জাল ভেদ করে বাংলার মোনাফেক কতিপয় রাজাকার মারফত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের খবর পৌঁছে যায় শত্রু শিবিরে। তাৎক্ষনিক তারাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধোর নানা পরিকল্পনা।
অবশেষে রাত শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধার দলটি আক্রমন করে শত্রু শিবিরে। মহুর্তে শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই। লড়ায়ের এক পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার দলটি যখন শত্রু সেনাদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল, টিক সে মহুর্তে ভোরের আভাস পেয়ে ব্রীজে মাইন বসানোর কাজে নিয়োজিত দলটি সেখান থেকে সরে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে ওঁত পেতে থাকা হানাদার বাহিনীর অসংখ্য সদস্য সাপাহারে প্রবেশ করে। এর পর তাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়ে প্রবল গতিতে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময় তাদের অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র সস্ত্রের কাছে হিমশিম খেয়ে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় মুক্তিযোদ্ধার মুল দলটিকে।
এসময় শত্রু পক্ষের গুলির আঘাতে যুদ্ধের মাঠেই শাহাদাত বরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল হামিদ সহ নাম নাজানা মোট ১৫জন। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহম্মদ উল্লাহ, সোহরাব হোসেন, নুরুল ইসলাম সহ অনেকে। এ ছাড়া শত্রুদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন ৮জন। শত্রুরা এই আটক ৮জনের ৪জনকে পত্নীতলার মধইল স্কুলের ছাদে তুলে কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে লাশগুলি লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। ২জনকে ধরে এনে মহাদেবপুরের একটি কূপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয়। শেষে ধৃত মুক্তিযোদ্ধা সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু নাছর গোলাম ওয়াহেদ গেটের ও মহাদেবপুরের জোয়ানপুর গ্রামের মৃত এস এম আবেদ আলীর পুত্র টগ বগে যুবক এস এম জাহিদুল ইসলামকে ধরে এনে নাটোরের রাজবাড়ীতে তৈরীকৃত তাদের জেলখানায় বন্দি করে রাখে। সেখানে তারা শত্রু সেনাদের হাজারো নির্যাতন সহ্য করে সুযোগ বুঝে একদিন জেলের প্রাচীর টপকিয়ে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগে সাপাহারকে আর হানাদার মুক্ত করা যায়নি।
সাপাহার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে এলাকার স্বার্থনেশী বর্বর চরিত্রের কিছু লোক মিলিত হয়ে হত্যা-নারী ধর্ষন এমনকি লুটপাট ও ডাকাতি কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই ১৩ সেপ্টেম্বর দিনটি ফিরে আসলে সাংবাদিকরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি তোলেন দিবসটি জাতীয় মর্যাদার পালন করার জন্য।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.