উপকূল থেকে কেন গভীর সমুদ্রে সরে যাচ্ছে ইলিশ

উপকূল থেকে কেন গভীর সমুদ্রে সরে যাচ্ছে ইলিশ

উপকূল থেকে কেন গভীর সমুদ্রে সরে যাচ্ছে ইলিশ
উপকূল থেকে কেন গভীর সমুদ্রে সরে যাচ্ছে ইলিশ

অনলাইন ডেস্ক: ভরা মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাচ্ছেন না নদী ও সমুদ্রের উপকূলবর্তী এলাকায় মাছ শিকার করা জেলেরা। উপকূল থেকে ইলিশ সরে গেছে গভীর সমুদ্রে। গবেষকরা বলছেন নদীর মোহনা ভরাট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর সমুদ্রে সরে যাচ্ছে ইলিশ। এ অবস্থায় ইলিশ আহরণ বৃদ্ধির জন্য নদীর মোহনা খননের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকারের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলছেন গবেষকরা।

কারিগরি সক্ষমতার অভাবে গভীর সমুদ্রে যেতে পারছেন না জেলেরা

উপকূল থেকে ইলিশ মাছ গভীর সমুদ্রে সরে গেলেও ইলিশের ঝাঁকের খোঁজে গভীর সমুদ্রে যেতে পারছেন না জেলেরা। এর কারণ হিসেবে কারিগরি সক্ষমতা এবং সরকারের উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করছেন তারা।

এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী সময় সংবাদকে বলেন, গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করার জন্য আধুনিক ও শক্তিশালী ট্রলারসহ যেসব সরঞ্জাম এবং উপকরণ দরকার, তার জন্য কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। অধিকাংশ জেলেরই কোটি টাকা ব্যয় করে মাছ শিকার করার সক্ষমতা নেই। জেলেদের গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের সক্ষমতা বাড়াতে তাই সরকারের সহায়তার বিকল্প নেই।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মোহনা ভরাট হওয়ায় পথ হারাচ্ছে ইলিশ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ এ. বি. সিদ্দিকের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্রের পরিবর্তন হয়েছে। নদী ও উপকূলবর্তী এলাকায় ইলিশ এখন আর বিচরণ করে না। ইলিশ বিচরণ করছে গভীর সমুদ্রে।

গবেষকরা বলছেন, ইলিশ মাছের বিচরণের উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ২২ ডিগ্রি থেকে ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে নদী ও উপকূলবর্তী সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও বেশি।

বছরে ধরা পড়ে চল্লিশ হাজার কোটি টাকার ইলিশ

দেশের জাতীয় অর্থনীতি বা জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। একক প্রাকৃতিক পণ্য হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান ইলিশের। ২০২১ সালে দেশে প্রায় ছয় লাখ টন ইলিশ ধরা পড়েছে। এ বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এখনো ঠিক হয়নি। ভোক্তা পর্যায়ে এখন প্রতি কেজি ইলিশের বাজারমূল্য সব ধরনের সাইজ বিবেচনায় গড়ে ৬শ থেকে আটশ টাকা ধরলে ছয় লাখ টন ইলিশের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৩৬ থেকে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন। এর ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ ছিল ইলিশ।

বিশ্বের মোট ইলিশের ৭৫ শতাংশই বাংলাদেশের

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বিশ্বের মোট উৎপন্ন ইলিশের ৭৫ শতাংশই হচ্ছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারে ১৫ শতাংশ, ভারতে ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশে ধরা পড়ে ৫ শতাংশ ইলিশ। দেশে শুধু ইলিশ ধরার পেশায় নিয়োজিত আছেন প্রায় পাঁচ লাখ জেলে। পরিবহন, বাজারজাত মিলে ধরলে আরো কয়েক লাখ মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি ইলিশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদও পেয়েছে বাংলাদেশ। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মাছটি।

বাংলাদেশে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ’ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দেশের ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’র ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের প্রায় সর্বত্রই ইলিশের বিচরণ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘ্ন রাখাসহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে ২০১৯ সালে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজর্ভ এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

ইলিশের বৈচিত্রময় জীবন চক্র

বৈচিত্র্যময় জীবন ইলিশের। সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননকালীন ডিম ছাড়ার জন্য স্বাদু পানিতে ফিরে আসে ইলিশ। এ সময়ে দৈনিক প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে মা ইলিশ। প্রজননের উদ্দেশ্যে একটি ইলিশ প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উজান পাড়ি দিতে পারে। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে স্বাদ বাড়ে ইলিশের। একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয়। রেনু ইলিশের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। বেঁচে থাকা রেনুগুলো ৭ থেকে ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়ানোর পর জাটকা হিসেবে সমুদ্রে চলে যায়। বঙ্গোপসাগরে ১২ থেকে ১৮ মাস বিচরণের পর এসব জাটকা পরিণত হয় প্রজননক্ষম পূর্ণাঙ্গ ইলিশে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এ সময়েই প্রায় ৮০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়ে।

আরও বাড়ানো সম্ভব ইলিশের উৎপাদন

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ‘জাটকা ও ইলিশের প্রাচুর্য ও বিচরণক্ষেত্র রক্ষা এবং জেলেদের বিকল্প আয়ের উপায় নির্ধারণ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন মৌসুমে প্রায় দেড় কোটির বেশি মা মাছ ধরা হয়। আর প্রতি বছর দেশের নদীগুলো থেকে ৩৫ কোটির বেশি জাটকা মাছ ধরা হয়। অথচ এসব জাটকা ইলিশের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ দিলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি বিচরণক্ষেত্রগুলোর আরও বেশি সুরক্ষা দেয়া গেলে মাছের উৎপাদন অনেকখানিই বাড়বে।

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply